তুমি কি কখনো ভেবেছো, সমাজের কঠিন বাস্তবতা আর মানুষের মনস্তত্ত্ব কীভাবে গল্পের চরিত্রে ফুটে ওঠে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শাস্তি’ গল্পে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়। এই গল্পের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে সমাজের নানা স্তরের মানুষের জীবনসংগ্রাম, সম্পর্কের টানাপোড়েন, নারী-পুরুষের অবস্থান, এবং আত্মত্যাগের করুণ চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ‘শাস্তি গল্পের চরিত্র বিশ্লেষণ করো’—এই অনুরোধে আজ তোমার সামনে তুলে ধরছি গল্পটির প্রধান চরিত্রগুলো, তাদের মনস্তত্ত্ব, এবং সমাজে তাদের অবস্থান।
বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য এই গল্প শুধু সাহিত্য নয়, বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। এখানে দরিদ্র কৃষক পরিবার, তাদের অভাব-অনটন, দাম্পত্য কলহ, সমাজের বিচারব্যবস্থা—সবকিছুই যেন একসাথে মিশে আছে। তুমি যদি কখনো পারিবারিক টানাপোড়েন, অভিমান, বা আত্মত্যাগের গল্প শুনে থাকো, তাহলে ‘শাস্তি’ গল্পের চরিত্রগুলো তোমার কাছে খুবই আপন লাগবে। চল, এই চরিত্রগুলোকে একটু গভীরভাবে দেখি—তাদের জীবন, সিদ্ধান্ত, এবং গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সেই চরম মুহূর্তগুলো বিশ্লেষণ করি।
‘শাস্তি’ গল্পের মূল চরিত্রসমূহ

প্রধান চরিত্রের তালিকা
- দুখিরাম রুই (বড় ভাই)
- ছিদাম রুই (ছোট ভাই)
- রাধা (দুখিরামের স্ত্রী, বড় বউ)
- চন্দরা (ছিদামের স্ত্রী, ছোট বউ)
- রামলোচন চক্রবর্তী (গ্রামের জমিদার ও বিচারক)
চরিত্রগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
চরিত্র | পরিচয় ও ভূমিকা | বৈশিষ্ট্য | গল্পে গুরুত্ব |
---|---|---|---|
দুখিরাম | বড় ভাই, খেটে খাওয়া কৃষক | রাগী, হতাশ, সহজ-সরল | ঘটনার সূত্রপাত |
ছিদাম | ছোট ভাই, দুখিরামের সহোদর | চতুর, আত্মকেন্দ্রিক, দ্বিধাগ্রস্ত | সিদ্ধান্তের মোড় ঘুরায় |
রাধা | দুখিরামের স্ত্রী, বড় বউ | মুখরা, হতাশ, সাহসী | নির্মম পরিণতির শিকার |
চন্দরা | ছিদামের স্ত্রী, ছোট বউ | নিরীহ, চঞ্চল, আত্মত্যাগী | গল্পের ট্র্যাজিক নায়িকা |
রামলোচন | গ্রাম্য জমিদার ও বিচারক | কর্তৃত্বপরায়ণ, বিচক্ষণ | বিচারক হিসেবে উপস্থিত |
দুখিরাম রুই: অসহায়তার প্রতীক
দুখিরাম রুই গল্পের বড় ভাই। সারাদিন কঠোর পরিশ্রমের পরও তার সংসারে শান্তি নেই। মজুরি বঞ্চনা, দারিদ্র্য, স্ত্রীর কটু কথা—সব মিলিয়ে তার জীবন বিষাদে ভরা। রাধার সঙ্গে তার সম্পর্কের টানাপোড়েন শেষ পর্যন্ত তাকে এক ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। ক্ষুধা ও রাগের চরম মুহূর্তে সে স্ত্রীর মাথায় দা চালিয়ে দেয়। এই কাজের জন্য সে নিজেই হতবাক, অপরাধবোধে কাতর। দুখিরাম চরিত্রটি আমাদের দেখায়, চরম দারিদ্র্য ও মানসিক চাপ মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে।
ছিদাম রুই: আত্মরক্ষার চরম সিদ্ধান্ত
ছিদাম, দুখিরামের ছোট ভাই, গল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ভাইকে বাঁচাতে সে নিজের স্ত্রীর ওপর খুনের দায় চাপিয়ে দেয়। তার যুক্তি—“বউ গেলে বউ পাইব, কিন্তু ভাই গেলে ভাই পাইব না।” এই কথায় তার আত্মকেন্দ্রিকতা ও সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা প্রকাশ পায়। ছিদাম পরে চন্দরাকে বাঁচাতে চাইলেও, তার সিদ্ধান্তের জন্য চন্দরার জীবন শেষ হয়ে যায়। ছিদামের চরিত্রে দ্বিধা, অপরাধবোধ, এবং আত্মরক্ষার প্রবণতা স্পষ্ট।
রাধা: দুঃখিনী ও প্রতিবাদী নারী
রাধা, দুখিরামের স্ত্রী, গল্পের বড় বউ। সংসারের অভাব-অনটন, স্বামীর অবহেলা, এবং নিজের কষ্টের কথা সে মুখ ফুটে বলে। তার মুখরা স্বভাব, প্রতিবাদী মনোভাব, এবং সংসার চালানোর সংগ্রাম গল্পে স্পষ্ট। রাধার মৃত্যু গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সে একদিকে সমাজের নিপীড়িত নারীর প্রতীক, অন্যদিকে নিজের কষ্টের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।
চন্দরা: আত্মত্যাগী ও প্রতিবাদী নারীর প্রতিচ্ছবি
চন্দরা, ছিদামের স্ত্রী, গল্পের ছোট বউ। তার বয়স মাত্র ১৭-১৮ বছর। সে সহজ-সরল, চঞ্চল, এবং সংসারের ছোটখাটো আনন্দে খুশি থাকে। কিন্তু স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতায় সে বজ্রাহত হয়। ছিদামের অনুরোধে সে খুনের দায় নিজের কাঁধে নেয়, অথচ শেষ পর্যন্ত কারও কথায় নিজের বক্তব্য থেকে সরে আসে না। চন্দরার আত্মত্যাগ, অভিমান, এবং দৃঢ়তা গল্পের সবচেয়ে করুণ ও শক্তিশালী দিক। মৃত্যুর আগে তার “মরণ!” উচ্চারণে তার অভিমান ও আত্মসম্মান স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চন্দরা শুধু গল্পের ট্র্যাজিক নায়িকা নয়, বরং সমাজের নারীর আত্মমর্যাদা ও প্রতিবাদের প্রতীক।
রামলোচন চক্রবর্তী: সমাজের বিচারক
রামলোচন চক্রবর্তী গ্রামের জমিদার ও বিচারক। তার উপস্থিতি গল্পে সমাজের বিচারব্যবস্থা ও ক্ষমতার প্রতীক। সে দুই ভাইয়ের পরিবারে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের বিচার করে। রামলোচনের চরিত্রে কর্তৃত্ব, বিচক্ষণতা, এবং সমাজের প্রচলিত বিচারপ্রক্রিয়ার প্রতিফলন দেখা যায়।
চরিত্রগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ
দিক | দুখিরাম | ছিদাম | রাধা | চন্দরা |
---|---|---|---|---|
পারিবারিক ভূমিকা | বড় ভাই, স্বামী | ছোট ভাই, স্বামী | বড় বউ, স্ত্রী | ছোট বউ, স্ত্রী |
সিদ্ধান্ত | হঠাৎ রাগে খুন | স্ত্রীকে বলি দেয় | প্রতিবাদী | আত্মত্যাগী |
মনোভাব | হতাশ, রাগী | দ্বিধাগ্রস্ত | সাহসী, মুখরা | নিরীহ, দৃঢ় |
গল্পে ভূমিকা | ঘটনার সূত্রপাত | মোড় ঘুরিয়ে দেয় | নিহত | ট্র্যাজিক নায়িকা |
আত্মসম্মান | কম | কম | মাঝারি | সর্বোচ্চ |
‘শাস্তি’ গল্পে নারী চরিত্রের অবস্থান
এই গল্পে নারী চরিত্রগুলো—বিশেষত চন্দরা ও রাধা—সমাজের নিপীড়িত, অবহেলিত, এবং আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন নারীর প্রতিচ্ছবি। চন্দরার আত্মত্যাগ, অভিমান, এবং প্রতিবাদী মনোভাব আজও সমান প্রাসঙ্গিক। রাধার মুখরা স্বভাবও সমাজের অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ। গল্পটি দেখায়, নারীরা কেবল ভুক্তভোগী নয়, বরং আত্মসম্মান ও প্রতিবাদের প্রতীক।
‘শাস্তি’ গল্পের চরিত্র বিশ্লেষণে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক
- দারিদ্র্য, অভাব, এবং সামাজিক অব্যবস্থা চরিত্রগুলোর মনস্তত্ত্বে গভীর প্রভাব ফেলে।
- নারী চরিত্রগুলো শুধু নিপীড়িত নয়, বরং আত্মমর্যাদার প্রতীক।
- পুরুষ চরিত্রগুলো সমাজের প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার প্রতিচ্ছবি।
- চন্দরার আত্মত্যাগ ও অভিমান গল্পের ট্র্যাজিক ক্লাইম্যাক্স তৈরি করে।
- গল্পের প্রতিটি চরিত্র বাস্তব জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত, যা পাঠকের মনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।
FAQ: ‘শাস্তি’ গল্পের চরিত্র বিশ্লেষণ
১. ‘শাস্তি’ গল্পের প্রধান চরিত্র কারা?
দুখিরাম, ছিদাম, রাধা, চন্দরা, এবং রামলোচন চক্রবর্তী—এই পাঁচজন গল্পের মূল চরিত্র।
২. চন্দরা চরিত্রের বিশেষত্ব কী?
চন্দরা আত্মত্যাগী, দৃঢ়, এবং আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন। স্বামীর অনুরোধে মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিলেও, নিজের অবস্থান থেকে সরেনি।
৩. ছিদাম কেন চন্দরার ওপর খুনের দায় চাপায়?
ভাইকে বাঁচাতে ছিদাম নিজের স্ত্রীর ওপর খুনের দায় চাপায়, কারণ তার কাছে ভাইয়ের জীবন স্ত্রীর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।
৪. রাধা চরিত্রটি কেমন ছিল?
রাধা মুখরা, প্রতিবাদী, এবং সংসারের অভাব-অনটনে ক্লান্ত। তার মৃত্যু গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
৫. ‘শাস্তি’ গল্পে নারী চরিত্রের অবস্থান কীভাবে ফুটে ওঠে?
নারী চরিত্রগুলো নিপীড়িত হলেও, তাদের আত্মসম্মান ও প্রতিবাদী মনোভাব গল্পের মূল শক্তি।
উপসংহার
‘শাস্তি’ গল্পের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে তুমি দেখবে, এখানে শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়, বরং সমাজের বাস্তবতা, দারিদ্র্য, এবং বিচারব্যবস্থার প্রতিফলন ফুটে উঠেছে। চন্দরার আত্মত্যাগ, ছিদামের আত্মকেন্দ্রিকতা, দুখিরামের অসহায়ত্ব, এবং রাধার প্রতিবাদী মনোভাব—সব মিলিয়ে গল্পটি আজও সমান প্রাসঙ্গিক। তুমি যদি সমাজের গভীর সংকট, নারী-পুরুষের অবস্থান, এবং আত্মসম্মানের মূল্য বুঝতে চাও, তাহলে ‘শাস্তি’ গল্পের চরিত্র বিশ্লেষণ তোমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গল্পটি পড়ো, ভাবো, এবং নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখো—তাহলে এর গভীরতা আরও ভালোভাবে অনুভব করতে পারবে।