ভাস্কো দা গামার পর্তুগালে

ভাস্কো দা গামার পর্তুগালে

ভাস্কো দা গামার পর্তুগালে । ভাস্কো দা গামার নাম শুনলেই মনে পড়ে যায় স্কুলবেলার স্মৃতি। সম্ভবত চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াকালীন সমাজ টিচারের মুখে প্রথম শুনি ভাস্কো দা গামার কথা, সেই সাথে পর্তুগিজ আর পর্তুগালের কথা।

মাঝে সময় পেরিয়েছে অনেকটা। এখন পর্তুগাল বলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ২ হাত তোলা গ্ল্যাডিয়েটরের ভঙ্গিতে তোলা ছবিটা।

গত বছর অল্পের জন্য ইউরোপ ট্যুর মিস হয়েছে। এবার তাই পর্তুগালের লিসবনে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সে যোগদানের কথা কোনও কিছু চিন্তা না করেই হ্যাঁ করে দিলাম। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে হবে আমাদের যাত্রা। যথাসময়ে ভিসা আর ছুটির ব্যবস্থা হয়ে গেল।

এখানে বলে রাখি পর্তুগাল সেনঝেন চুক্তিভুক্ত দেশ, তাই সেনঝেন অধিভুক্ত যেকোনো দেশের ভিসা নিয়ে পর্তুগাল ভ্রমণ সম্ভব। বাংলাদেশে যেহেতু পর্তুগালের দূতাবাস নেই, তাই আমাদের ফ্রেঞ্চ দূতাবাসে ভিসার জন্য যেতে হয়েছিল। আমাদের দেয়া হয়েছিল ১ মাসের মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা।

লিসবনে আমার এক মামা আর খালু থাকেন। ভিসা হাতে পেতেই তাদের সাথে যোগাযোগ শুরু করে দিলাম। আমার চেয়ে দেখি তাদের উৎসাহই বেশি। কনফারেন্স শেষে অনেকেই দেশে ফিরে আসবে, তাই সবার রিটার্ন টিকিট ৫ দিন পরই করা ছিল।

কিন্তু আমি আরো ৫ দিন বাড়িয়ে মোট ১০ দিন পর্তুগালে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। বেশ কিছু পয়সা খরচ হলেও পরে ভালোমত লিসবন, সিন্ত্রা, কাসকাইস, কাবো দা রোকা, কস্টা দা ক্যাপারিকা ঘুরতে পাড়ায় সেই সামান্য কিছু টাকার দুঃখ কর্পূরের মতোই দ্রুত উবে গিয়েছিল।

যথাসময়ে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে উপস্থিত হলাম। দলে বেশ কিছু পুরাতন মুখ দেখে আশ্বস্ত হলাম। এবারই প্রথম ইউরোপ ট্যুর বলে কথা। অজানা অনন্দ আর আশঙ্কার যুগপৎ দোলাচালে দুলছিল হৃদয়।

অন্যদিকে পরিবার পরিজন ছেড়ে বেশ কিছুদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি, মনটাও একটু ভারাক্রান্ত। সব ছাপিয়ে নতুন দেশ দেখার উত্তেজনায় অন্য সব অনুভূতিগুলি বোধহয় ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। এয়ার ট্রাফিকের কারণে কিছুটা দেরিতে, রাত ২টায় এমিরেটস এয়ার ওয়েজের জেট প্লেন ছাড়ল।

দুবাইতে ২ ঘন্টার ট্রানজিট মিলিয়ে প্রায় ১২ ঘণ্টার জার্নি। ঠিক করলাম সময়টা কাজে লাগানো যাক। এ সুযোগে লিসবন সম্পর্কে কিছুটা আইডিয়া নেয়া আরকি। মোবাইলে ডাউনলোড করা ফাইল খুলে পড়তে শুরু করে দিলাম।

ইউরোপের দক্ষিণ পশ্চিমের শেষ দেশ পর্তুগাল। স্পেনের সাথে ভাগাভাগি করে আইবেরিয়ান উপদ্বীপে এর অবস্থান। ভৌগোলিকভাবে এবং সাংস্কৃতিকভাবে কিছুটা তার প্রতিবেশী থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও পর্তুগালের রয়েছে একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস, অনন্য সংস্কৃতি, প্রাণবন্ত শহর এবং চোখ জুড়ানো গ্রামাঞ্চলে। পর্তুগালকে বলা হয়ে থাকে সারফারদের জন্য স্বর্গরাজ্য আর গলফারদের মক্কা।

পর্তুগাল উষ্ণ ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে একটি। যার দরুন সারা বছরই চমৎকার আবহাওয়া বিরাজ করে। লিসবন হচ্ছে পর্তুগালের রাজধানী। অন্যান্য বিখ্যাত শহরগুলোর মধ্যে পোর্তো আর আল গারাভ অন্যতম। পোর্তো বিখ্যাত তার পোর্ট ওয়াইন আর ফুটবল ক্লাব এফসি পোর্তোর জন্য। লিসবনের বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব হচ্ছে স্পোর্টিং লিসবন।

সমুদ্রের মুখোমুখি হওয়া বিরল পশ্চিম ইউরোপীয় শহরগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে লিসবন। ইতিহাস, ঐতিহ্য, আরামদায়ক আবহাওয়া, মুখরোচক খাবার আর বিখ্যাত সব স্থাপনার জন্য লিসবন পরিণত হয়েছে অন্যতম হলিডে ডেসটিনেশনে। পরতে পরতে কখন জানি চোখ বুজে এসেছে। ঘুম ভাঙল পাসের সিটের যাত্রীর ডাকে। খাবার দেয়া হচ্ছে। প্লেনের খাবার আমার কখনই ভালো লাগে না, কিন্তু পেটের দায়ে খেতে হয় বলে খাওয়া।

কোনোরকমে সেই অখ্যাদ্য পেটে চালান করে দিয়ে আবার পড়তে শুরু করে দিলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ জ্ঞানার্জন ভালো লাগলো না, তাই প্লেনের এলসিডি প্যানেলে মুভি দেখা শুরু করলাম।

দুবাইতে ২ ঘন্টা যাত্রা বিরতি দেখতে দেখতেই কেটে গেল। আবারো সেই একঘেয়ে যাত্রা। আবারো মুভি দেখা শুরু করলাম। সবশেষে লিসবন বিমানবন্দরে যখন প্লেন ল্যান্ড করল তখন স্থানীয় সময় দুপুর সাড়ে ১২টা। ঘড়ির সময় পরিবর্তন করে নিলাম।

সিকিউরিটি চেকআপের ঝামেলা পেরিয়ে লাগেজ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি শুভ মামা আর তার সহকর্মী ফয়সাল মামা দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনেক দিন পর তাদের সাথে দেখা। দীর্ঘদিন পর প্রিয়জনের সাথে দেখা হলে যা হয় আর কী। ভুলেই গেলাম সাথে আরও লোক আছে।

সম্বিৎ ফিরল দলনেতা সাইফুল ভাইয়ের ডাকে। সরি বলে একে একে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। মামাকে তার জন্য আনা ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে আমরা আমাদের জন্য ঠিক করে রাখা বাসে উঠলাম। কথা হলো রাতে মামারা আমাদের হোটেলে এসে দেখা করবে।

আমাদের হোটেল তাদের ওয়ার্কিং প্লেসের কাছেই। বাস ড্রাইভারের নাম জন। বেশ হ্যান্ডসাম, প্রায় সাড়ে ছয় ফুট লম্বা। দেখে কিছুতেই ড্রাইভার বলে মনে হয় না, বরং কোন হলিউডের সিনেমার নায়ক হলেই বরং তাকে মানাত। আজকের দিনে জনই আমাদের ড্রাইভার কাম-গাইড। গাড়ি ছাড়ার আগেই জন আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল লিসবনের সাথে।

ভাস্কো দা গামার পর্তুগালে

লিসবন প্রথম দিন

সাতটা পাহাড়ের উপরে গড়ে উঠেছে লিসবন শহর। ইউরোপের অন্যতম পুরনো ইতিহাস সমৃদ্ধ শহর। ইতিহাসের অনেক অধ্যায়ের সাক্ষী আজকের এই লিসবন। আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এখানে জনবসতি শুরু হয়। সেই সময় কারথেজিয়ান আর ফিনিশিয়ান নাবিকদের কাছে এর পরিচিতি ছিল “আলিস উব্বো” নামে।

তবে কথিত আছে যে, ট্রয় থেকে ইথাকায় ফেরার পথে গ্রিক বীর অডিসিয়াস এক জায়গায় বাজ পড়ে আগুন ধরতে দেখে সেখানে একটা শহর পত্তন করেন; আর তার নাম দেন “অলিসাপো”। ফিনিশীয়দের আমলে তা হয় “আলিস উব্বো” আর মুরদের (ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান) আমলে “আল আশবুনা” পরবর্তীতে লিসবোয়া।

পর্তুগিজ ভাষাতে লিসবনের নাম লিসবোয়া। তবে অনেকে মনে করেন লিসবনের ইতিহাস আরও অনেক পুরনো, কারণ শহরের প্রধান গির্জার নিচে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে। লিসবনের অলিতে গলিতে ছড়িয়ে রয়েছে বিস্ময়কর যাত্রা আর যুদ্ধের কাহিনী। ভাস্কো দা গামার ভারত যাত্রা এই শহর থেকেই শুরু হয়েছিল।

সমুদ্রের পারে অবস্থিত হওয়ায় লিসবন উপহার দিয়েছে বিখ্যাত সব নাবিকদের। তাদের মধ্যে অন্যতম “হেনরি দ্য ন্যাভিগেটর”। এসব নাবিকরা সারা দুনিয়ার সম্পদ এনে জড়ো করতেন লিসবনে, যার ফলে বিশাল এক ভুখণ্ডের রাজধানীতে পরিণত হয় লিসবন। ১৭৫৫ সালের প্রলয়ঙ্করি ভূমিকম্পে সমগ্র লিসবন শহর লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।

মারকুইস দ্যা পম্বাল নামে জৈনেক শাসকের আমলে আবার নতুন করে গড়ে তোলা হয় এই শহর। বর্তমান শহরের ডাউন-টাউন বাইশা, চিয়াদো আর কমার্শিয়াল স্কয়ার (পারকা ডেকমারসিও) তখনই প্রতিষ্ঠিত হয়। শহরের মুখ্য আকর্ষণগুলোকে ছয় ভাগে ভাগ করা যায়- শহরের কেন্দ্রস্থল তথা বাইশা, বাইরো আলতো, আলফামা, বেলেম, লিসবন কোস্ট আর আধুনিক শহর।

আমাদের সাথে কথা বলতে বলতে এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের বাস চলতে শুরু করল শহরের কেন্দ্রস্থল বাইশা এলাকায় হোটেলের দিকে। প্রশস্ত রাস্তার দুইপাশে বেশ চওড়া ফুটপাথ আর গোল চত্বরের মাঝে বিভিন্ন মূর্তি। একেকটা চত্বরের একেক নাম। এখানে চত্বরকে বলে প্রাকা আর রাস্তাকে বলে রুয়া।

যেমন শহরের মূল চত্বর প্রাকা ডে রসিও ( আমাদের শাপলা চত্বরের মতো আর কী)। আমাদের আপাত গন্তব্য রসিও চত্বরের দিকেই, এখান থেকে হাঁটা পথ আমাদের হোটেল। এরপর আর গাড়ি যাবে না, তাই দুই পাই সম্বল। কিন্তু দলনেতা সিদ্ধান্ত দিলেন পথে কোনও রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খেয়ে তারপর হোটেলের দিকে ফিরব, কারণ একবার হোটেলে ঢুকলে বের হতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।

অগত্যা পথে এক বাঙালি হোটেলে নেমে আমরা ভাত আর মুরগির মাংস দিয়ে দুপুরের খাবার সারলাম। আশ্চর্যজনকভাবে এ হোটেলের নাম “বাঙালি হোটেল”, মালিক সিলেটি। আরেক দিন আসব শুনে কথা দিলেন পরের দিন আলুভর্তা খাওয়াবেন। ভরপেট খেয়ে আবার বাসে চড়ে বসলাম।

সামান্য দূরত্বেই রসিও চত্বর। পথে পার হয়ে এলাম রেস্তুতুরিওস চত্বর আর লিবার্টি অ্যাভিনিউ। বাইশা এলাকায় ঢোকার মুখেই রেস্তুতুরিওস চত্বর পর্তুগিজ ভাষায় “মনুমেন্টো দ্য রেস্টুরাদোরেস”। চত্বরের দুই পাশে অসংখ্য বারোক আর নিউ বারোক স্টাইলের ভবন, যেগুলোর বেশিরভাগই কোনও না কোনও রেস্তোরাঁ। “মনুমেন্টো দ্য রেস্টুরাদোরেস” ঠিক মাঝখানে একটা বিশাল অবেলিস্ক, যা বানানো হয়েছিল ১৬৪০ এর বিপ্লবের কথা স্মরণ রেখেই।

ওই সনেই ৬০ বছরের স্প্যানিশ শাসনের পরাধীনতা থেকে মুক্তি পায়। অবেলিস্কের দুই পাশে দুইটা ব্রোঞ্জের মূর্তি-দক্ষিণে “ভিটোরিয়া” আর উত্তরে “জেনিও দ্যা ইন্ডিপেন্ডেন্স”। অবেলিস্কের চারপাশের চত্বর ছোট ছোট সাদাকালো পাথর বসিয়ে বানানো। পুরো লিসবনে এইরকম অসংখ্য চত্বর আর রাস্তা সাদাকালো পাথরে সাজানো।

বাস থেকে আমরা নামলাম রসিও চত্বরে। রসিও লিসবনের প্রধান চত্বর, একে ঘিরেই লিসবনের সমগ্র আয়োজন, শহরের প্রাণকেন্দ্র বলতে যা বোঝায় আরকি। এর প্রশাসনিক নাম দমপেদ্রো ৪ চত্বর। লন্ডনের ট্রাফলগার স্কোয়ারের সাথে এর অনেক মিল আছে।

চত্বরের ঠিক মধ্যেখানে একটা বিশাল সাদা রঙের করিন্থিয়াম কলামের মাথায় বসানো রাজা চতুর্থ পেদ্রোর মূর্তি। থামের গোঁড়ায় আরও চারটি নারী মূর্তি, যারা রাজা পেদ্রোর চারটি গুণের প্রতীক- ন্যায়বিচার, প্রাজ্ঞতা, শক্তি আর সংযম। পেদ্রো ছিলেন পর্তুগালের ২৮তম রাজা আর ব্রাজিলের প্রথম সম্রাট।

এর একপাশে ডোনা মারিয়া থিয়েটার। এর খুব কাছেই রসিও রেলস্টেশন। নব্য মানুলাইন রীতিতে বানানো রসিও রেলস্টেশনের বহির্ভাগে আটটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি দরজা, ১৬টা জানালা আর মাথার উপর একটা টাওয়ার ক্লক, সব মিলিয়ে মনকাড়া স্থাপত্য নকশা।

কোনো শহরের রেলস্টেশন যে এত সুন্দর হতে পারে এটা এই প্রথম দেখলাম। রসিও চত্বরে পেদ্রোর মূর্তির দুইপাশে দুটি খুব সুন্দর ফোয়ারা। একপাশে বেশ কিছু ফুলের দোকান।

এখান থেকেই প্রতিদিন ফ্রি ওয়াকিং ট্যুর শুরু হয়। আসলে কোনো শহরকে ভালোভাবে দেখতে হলে ওয়াকিং ট্যুরের বিকল্প নেই। আমাদের দলনেতা এখানেই আমাদের প্রতিদিনের মিটিং প্লেস ঠিক করে দিলেন।

বাস থেকে নামতেই রুয়া অগাস্তা দিয়ে চোখে পড়ল তাগুস (পর্তুগিজে তেজোস) নদীর নীল জল। কিছুদূর এগিয়েই এই নদী মিলিত হয়েছে আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে। এযাত্রা জলের আহবান উপেক্ষা করে লাগেজ নিয়ে আমাদের হোটেলের দিকে রওনা হলাম।

একটু আপ হিলে হলেও আমাদের হোটেল বরজেস চিয়াদো বেশ নামকরা আর ঐতিহ্যবাহী, চারপাশে সব টুরিস্ট এর ছড়াছড়ি। হোটেলে যখন চেক ইন করলাম তখন প্রায় ৩টা বাজে। কিছুক্ষণ গড়িয়ে নিতেই সাইফুল ভাইয়ের ফোন, ডিনারের জন্য বের হতে হবে। শীত প্রায় সমাগত, তাই একটু আরলি ডিনার আর কী।

বাইরে একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব থাকায় পাতলা একটা জ্যাকেট গায়ে দিয়ে বের হলাম। আবার রসিও স্কয়ার, আবার বাসে করে একটা পর্তুগিজ রেস্তোরাঁয়। এবার আমরা ট্রাই করলাম সারডিন, স্যামন আরো বেশ কিছু মাছ, কিন্তু কোনোটাই আমার কাছে খুব সুস্বাদু মনে হলো না।

মনে হচ্ছিল সব কাঁচা কাঁচা। ভদ্রতার খাতিরে কোনোরকমে সেই কুখাদ্য খেয়ে আবার হোটেলের দিকে রওনা দিলাম। হোটেলে ফিরতেই দেখি শুভ আর ফয়সাল মামা লবিতে বসে আছেন।

আমি আর আমার আরেক সফরসঙ্গী স্বপনদা তাদের সাথে বেড়িয়ে পড়লাম। আমাদের হোটেলের সামনেই একটা গলির মতো, সেটা দিয়ে নেমে নদীর ধারে গিয়ে বসলাম। নদীর ধারে বেশ ঠাণ্ডা। আমরা যেখানটাতে বসলাম এই যায়গার নাম পারকা দে কমারসিও বা কমারসিও চত্বর।



এটাকে বলা হয় লিসবনের লিভিং রুম। আসলেই তাই, নদীর ধারে শহর শুরুর মুখেই এই চত্বর। এটি যেখানে অবস্থিত আগে একটা সময় সেখানে ছিল রয়্যাল রিবেরিয়া প্যালেস।

১৭৫৫ সালের লিসবন ভূমিকম্প লিসবনকে প্রায় মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়, আর অনেক কিছুর মতোই রয়্যাল রিবেরিয়া প্যালেসও ধ্বংস হয়ে যায়। সেখানেই পরে নির্মাণ করা হয় কমার্স স্কয়ার, তাই এর আরেক নাম প্যালেস ইয়ার্ডো। এর ভূমিকম্প পূর্ববর্তী নাম ছিল তেরেরিও দ্যা পাকো।

সেই সময় এই চত্বর ছিল একটা মার্কেট প্যালেসের মতো, মানে আমাদের দেশের হাটের মতো। চত্বরের ঠিক মাঝখানে প্রায় ১৫ মিটার উঁচু ঘোড়ায় চড়া রাজা প্রথম দম জোস এর মূর্তি। মূর্তিকে পেছনে ফেলে শহরের দিকে এগিয়ে গেলেই রুয়া আগাস্তা নামের রাস্তা শুরু।

রাস্তার শুরুর ঠিক মুখেই রুয়া আগাস্তা খিলান বা আর্চ ওয়ে। আর্চের গায়ে বেশ কিছু মূর্তি আর উপরে একটা ঘড়ি লাগানো আছে। মামার কাছে জানতে পাড়লাম মূর্তিগুলোর একেকটা একেকটা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে- বীরত্ব, প্রতিভা আর গরিমা। এর সাথেই নিচের দিকে আছে ভাস্কো দ্য গামা আর মারকুইস দ্যা পম্বালের মূর্তি। আর্চের ঠিক পাশেই লিসবনের সবচেয়ে পুরানো ক্যাফে- “ক্যাফে মারতিনহো দ্য আরকাডা”।

১৭৭৮ সাল থেকে শুরু করে আজ অবধি এটি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ক্যাফে থেকে দান দিকে সামান্য একটু এগিয়ে গেলাম, অদ্ভুত সুন্দর একটা চার্চের সামনে নিজেকে আবিষ্কার করলাম যার নাম চার্চ অব কনসেপশন। চার্চের খিলানটি ভূমিকম্প পূর্ববর্তী চার্চ অব লেডি অব মারসি থেকে নেয়া। চার্চের ভিতরতাও অসম্ভব সুন্দর। চার্চের ভিতর থেকে যতক্ষণে বের হলাম, ততক্ষণে রাত প্রায় ১১ টা।

অগত্যা আবার হোটেলের দিকে রওনা দিলাম। ফেরার পথে চোখে পড়লো সিটি কাউন্সিল; যা পারকা দো মিউনিসিপিও নামে পরিচিত। এটিও মারকাস দ্য পম্বাল নির্মিত। সাদাকালো পাথরের খোয়ায় নির্মিত চত্বরের ঠিক মাঝখানে একটা বাকানো মার্বেলের স্তম্ভ যার নাম পিলোরি। চত্বরের চারপাশে বেশ কিছু স্থাপনা।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে টাউন হল আর মানি মিউসিয়াম। এখান থেকে রুয়া দো আর্সেনাল ধরে এগিয়ে চললাম। আশেপাশে অনেক পুরনো অট্টালিকা ভাঙ্গা হচ্ছে। কিন্তু একটা জিনিস খুব অবাক করলো, প্রত্যেকটা অট্টালিকার বাইরের পুরনো অংশ অবিকৃত রেখে ভেতরের অংশ পুনঃনির্মাণ করা হচ্ছে।

ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে ধরে রাখার এ অভিনব প্রয়াস দেখে সত্যই মুগ্ধ হলাম। সাথে সাথে অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো, ইস যদি আমাদের পুরান ঢাকার দালানগুলোকে এভাবে সংরক্ষণ করা যেত।

হাঁটতে হাঁটতে আমাদের হোটেলের কাছে এসে পড়লাম। ঘড়িতে রাত প্রায় ১২টা ছুঁই ছুঁই, অথচ দেখে বোঝার উপায় নেই। চারদিকে টুরিস্টের ছড়াছড়ি। এর মধ্যে কয়েকজন গিটার নিয়ে গান করছেন, সামনে গিটারের খাপ খোলা।

অনেকে তাতে পয়সাও ফেলছেন। একজন আবার একটা লাঠির উপর ভর দিয়ে শুন্যে বসে থাকার কসরত দেখাচ্ছেন। খুব ইচ্ছা করছিল আরো কিছুটা সময় এখানে কাটাই। কিন্তু এদিকে চোখ খুলে রাখতে পারছিলাম না। অগত্যা মামাদের বিদায় দিয়ে সোজা হোটেল রুমে। রুমে ঢুকে আর দেরি করলাম না, সোজা বিছানায়। শুতে না শুতেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম। (চলবে)

লেখক: আশরাফ উদ্দিন আহমেদ (শাকিল), চিকিৎসক, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল

আমাদের YouTube চ্যানেলটি ভিজিট করে আসতে পারেন এই লিংক থেকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *