ফিলমেট ৪০০ একটি শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক যা বাংলাদেশে অনেকেই বিভিন্ন সংক্রমণ নিরাময়ে ব্যবহার করে থাকেন। প্রতিদিন হাজারো মানুষ পাকস্থলীর সমস্যা, সংক্রমণ এবং বিভিন্ন প্রকার ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসকের কাছে যান, যেখানে ফিলমেট ৪০০ প্রায়শই একটি মূল চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে এই ওষুধটি কি, এর কার্যপ্রণালী কিভাবে কাজ করে এবং এটি কোন রোগের জন্য ব্যবহার করা উচিত – এসব বিষয়ে অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। আজকের এই লেখায়, আমরা ফিলমেট ৪০০ সম্পর্কে বিস্তারিত জানব, যা আপনাকে এই ওষুধ সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে সাহায্য করবে। আসুন জেনে নেই ফিলমেট ৪০০ এর সম্পূর্ণ বিবরণ, এর উপকারিতা থেকে শুরু করে সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যন্ত।
ফিলমেট ৪০০ কি | What is Filmet 400?

ফিলমেট ৪০০ হচ্ছে মেট্রোনিডাজল নামক উপাদান সমৃদ্ধ একটি অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ যা বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড দ্বারা উৎপাদিত। এটি নাইট্রোইমিডাজোল শ্রেণীর একটি অ্যান্টিবায়োটিক যা মূলত এনারুবিক (অক্সিজেনহীন পরিবেশে বেঁচে থাকে এমন) ব্যাকটেরিয়া এবং পরজীবী সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকরী।
এই ওষুধটি বাজারে বিভিন্ন রূপে পাওয়া যায়:
- ২০০মি.গ্রা. ট্যাবলেট
- ৪০০মি.গ্রা. ট্যাবলেট
- ২০০মি.গ্রা./৫মি.লি. সাসপেনশন
- ৫০০মি.গ্রা./১০০মি.লি. IV ইনফিউশন
ফিলমেট ৪০০ এর কাজ কি?
অনেকেই জানতে চান ফিলমেট ৪০০ এর কাজ কি? এই ওষুধটি আসলে কিভাবে আপনার শরীরে কাজ করে? মেট্রোনিডাজল, যা ফিলমেট ৪০০ এর মূল উপাদান, এটি ব্যাকটেরিয়ার DNA-র সাথে মিথস্ক্রিয়া করে DNA-র কাঠামো ধ্বংস করে এবং প্রোটিন সংশ্লেষণ বাধাগ্রস্ত করে, যা শেষ পর্যন্ত ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবীর মৃত্যুর কারণ হয়।
এনারুবিক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা মেট্রোনিডাজলের ৫-নাইট্রো গ্রুপ বিজারিত হয়, যা তারপর ব্যাকটেরিয়ার DNA-র সাথে যুক্ত হয়ে তাদের ধ্বংস করে। এভাবে ফিলমেট ৪০০ একটি ব্যাকটেরিসাইডাল (ব্যাকটেরিয়া নাশক) হিসেবে কাজ করে যা সংক্রমণ নিরাময়ে সাহায্য করে।
ফিলমেট ৪০০ কোন রোগের জন্য ব্যবহৃত হয়?
ফিলমেট ৪০০ বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। নিচে এর ব্যাপক ব্যবহার ক্ষেত্রগুলি দেওয়া হলো:
সাধারণ সংক্রমণে
- অস্ত্রোপচারের পর সংক্রমণ প্রতিরোধ (বিশেষ করে এনারুবিক ব্যাকটেরিয়া থেকে)
- সেপটিসেমিয়া (রক্তে সংক্রমণ)
- ব্যাকটেরেমিয়া
- পেরিটোনাইটিস (পেটের ভিতরের প্রদাহ)
- ব্রেইন এবসেস (মস্তিষ্কে ফোড়া)
পরজীবী সংক্রমণে
- ইউরোজেনিটাল ট্রাইকোমোনিয়াসিস
- অ্যামেবিয়াসিস (সকল ধরনের)
- গিয়ারডিয়াসিস
- ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজিনোসিস (নন-স্পেসিফিক ভ্যাজিনাইটিস)
অন্যান্য সংক্রমণে
- অ্যাকিউট আলসারেটিভ জিনজিভাইটিস (মুখের সংক্রমণ)
- পায়ের ঘা ও প্রেসার সোর
- দাঁতের তীব্র সংক্রমণ
ফিলমেট ৪০০ খাওয়ার নিয়ম
ফিলমেট ৪০০ সঠিকভাবে খাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অযথা বা ভুল পদ্ধতিতে ব্যবহার করলে এর কার্যকারিতা কমে যেতে পারে অথবা অপ্রত্যাশিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। নিচে বিভিন্ন অবস্থার জন্য মাত্রা দেওয়া হলো:
ট্রাইকোমোনিয়াসিস (প্রাপ্তবয়স্ক ও ১০ বছরের বেশি শিশু):
- ২০০ মি.গ্রা. দিনে ৩ বার অথবা ৪০০ মি.গ্রা. দিনে ২ বার, ৭ দিন
- সকালে ৮০০ মি.গ্রা. এবং রাতে ১-২ গ্রাম, ২ দিন
- ২ গ্রাম একবারে, ১ দিন
শিশুদের ক্ষেত্রে:
- ৭-১০ বছর: ১০০ মি.গ্রা. দিনে ৩ বার
- ৩-৭ বছর: ১০০ মি.গ্রা. দিনে ২ বার
- ১-৩ বছর: ৫০ মি.গ্রা. দিনে ৩ বার
অ্যামেবিয়াসিস:
- ৮০০ মি.গ্রা. দিনে ৩ বার, ৫ দিন
খেয়াল রাখবেন, এসব মাত্রা সাধারণ নির্দেশিকা মাত্র। আপনার চিকিৎসক আপনার অবস্থা অনুযায়ী ভিন্ন মাত্রা নির্ধারণ করতে পারেন।
ফিলমেট ৪০০ এবং অন্যান্য ওষুধের তুলনা
বিষয় | ফিলমেট ৪০০ (মেট্রোনিডাজল) | অ্যামক্সিসিলিন | এজিথ্রোমাইসিন |
---|---|---|---|
মূল কার্যপ্রণালী | এনারুবিক ব্যাকটেরিয়া এবং পরজীবী সংক্রমণ | ব্যাপক স্পেকট্রাম ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ | ম্যাক্রোলাইড অ্যান্টিবায়োটিক |
প্রধান ব্যবহার | অ্যামিবিক ডিসেন্ট্রি, ট্রাইকোমোনিয়াসিস | ইউরিনারি ইনফেকশন, সাইনাসাইটিস | শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ |
সাধারণ মাত্রা | ৪০০ মি.গ্রা. দিনে ৩ বার | ৫০০ মি.গ্রা. দিনে ৩ বার | ৫০০ মি.গ্রা. প্রথম দিন, তারপর ২৫০ মি.গ্রা. |
অ্যালকোহল সেবন | নিষিদ্ধ | মোটামুটি নিরাপদ | মোটামুটি নিরাপদ |
প্রধান পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া | মুখে ধাতব স্বাদ, বমি বমি ভাব | ডায়রিয়া, এলার্জি | পেট খারাপ, লিভার সমস্যা |
ফিলমেট ৪০০ এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
যেকোনো ওষুধের মতোই, ফিলমেট ৪০০ সেবনে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এগুলির মধ্যে রয়েছে:
- অপ্রীতিকর ধাতব স্বাদ মুখে অনুভব করা
- বমি বমি ভাব, বমি
- জিহ্বার উপরে আবরণ
- মাথা ঘোরা, মাথাব্যথা
- দুর্বলতা, অবসাদ
- প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হওয়া
- ত্বকে ফুসকুড়ি বা চুলকানি
- কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া
দীর্ঘদিন ব্যবহারে আরো কিছু জটিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, যেমন:
- স্নায়ুর ক্ষতি (নিউরোপ্যাথি)
- রক্তে শ্বেতকণিকার পরিমাণ কমে যাওয়া
- লিভারের কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়া
সতর্কতা ও সাবধানতা
ফিলমেট ৪০০ ব্যবহারের সময় নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত:
অবশ্যই এড়িয়ে চলুন:
- অ্যালকোহল: ফিলমেট ৪০০ গ্রহণ করার সময় এবং শেষ ডোজ নেওয়ার অন্তত ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অ্যালকোহল পান করবেন না। এতে ডাইসালফাইরাম প্রতিক্রিয়া (ত্বকে অত্যধিক রক্ত সরবরাহ, বমি, দ্রুত হৃদস্পন্দন) হতে পারে।
- গর্ভাবস্থা: বিশেষ করে গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে ফিলমেট ৪০০ ব্যবহার এড়িয়ে চলুন।
- স্তন্যদানকাল: স্তন্যদানকালে ফিলমেট ৪০০ ব্যবহার সম্পর্কে আপনার চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন।
সাবধানতা:
- যতটা সম্ভব কম সময়ে ব্যবহার করুন: দীর্ঘ সময় ব্যবহার করলে স্নায়ুর ক্ষতি হতে পারে।
- পরীক্ষা-নিরীক্ষা: দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারের সময় রক্তের কোষ গণনা করা উচিত।
- ড্রাইভিং ও মেশিন চালানো: ফিলমেট ৪০০ মাথা ঘোরা বা দৃষ্টি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, তাই সাবধানতা অবলম্বন করুন।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন
১. ফিলমেট ৪০০ কি খালি পেটে খাওয়া যাবে?
না, ফিলমেট ৪০০ সাধারণত খাবারের সাথে গ্রহণ করা ভালো। এতে পাকস্থলীতে জ্বালাপোড়া কম হয়।
২. ফিলমেট ৪০০ কতদিন খাওয়া যাবে?
এটি সংক্রমণের ধরন অনুযায়ী ভিন্ন, সাধারণত ৫-১০ দিন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক সময় নির্ধারণ করুন।
৩. ফিলমেট ৪০০ খাওয়ার সময় কোন খাবার এড়াতে হবে?
অ্যালকোহলজাতীয় পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। এছাড়া, অত্যধিক তেলযুক্ত ও মসলাদার খাবার কম খাওয়া উচিত।
৪. ফিলমেট ৪০০ কি গর্ভবতী মহিলারা সেবন করতে পারবেন?
না, বিশেষ করে গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে ফিলমেট ৪০০ সেবন এড়িয়ে চলুন। অন্য সময়েও চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সেবন করুন।
৫. ফিলমেট ৪০০ সেবনে প্রস্রাবের রঙ পরিবর্তন হবে?
হ্যাঁ, এটি সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। ফিলমেট ৪০০ সেবনে প্রস্রাবের রঙ গাঢ় বা হলুদাভ হতে পারে, যা চিন্তার কারণ নয়।
উপসংহার
ফিলমেট ৪০০ একটি শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক যা সঠিক ব্যবহারে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ থেকে মুক্তি দিতে সাহায্য করে। এটি এনারুবিক ব্যাকটেরিয়া এবং পরজীবী সংক্রমণের বিরুদ্ধে বিশেষভাবে কার্যকরী। তবে, এটি একটি শক্তিশালী ওষুধ হওয়ায় সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি। আপনার সংক্রমণের ধরন অনুযায়ী সঠিক মাত্রায় এবং সঠিক সময়ের জন্য ফিলমেট ৪০০ গ্রহণ করুন। সর্বদা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করুন এবং কোনো অস্বাভাবিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন। স্বাস্থ্যের বিষয়ে কোনো ধরনের চুক্তি না করে সর্বদা পেশাদার পরামর্শ নিন।