আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন, “মানুষ কাজী নজরুল ইসলাম ব্যাখ্যা” কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? আজকের সমাজে, ধর্ম, জাতি, বর্ণ, অর্থনৈতিক বিভাজন—এসবের ভিড়ে মানুষের আসল পরিচয় কোথায়? নজরুলের ‘মানুষ’ কবিতা বারবার মনে করিয়ে দেয়, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। এই কবিতার ব্যাখ্যা জানা মানে শুধু সাহিত্য বোঝা নয়, বরং নিজের জীবন, সমাজ ও মূল্যবোধকে নতুনভাবে দেখা। আপনি যদি ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক, বা কেবল একজন সচেতন মানুষ হন—এই লেখাটি আপনার জন্য।
নজরুলের কবিতার মূল কথা—মানুষের উপরে কিছু নেই। ধর্ম, জাত, গোত্র, ধন-সম্পদ—কিছুই মানুষের চেয়ে বড় নয়। মানবিকতা, সহানুভূতি, সাম্য, এবং অসাম্প্রদায়িকতা—এই চারটি মূলমন্ত্র নজরুলের ‘মানুষ’ কবিতার প্রাণ। এই ব্যাখ্যা জানলে আপনি নিজেও নিজের সমাজ, পরিবার, এমনকি নিজের মনকে নতুনভাবে দেখতে পারবেন।
কাজী নজরুল ইসলাম ও তাঁর মানবতাবাদী দর্শন

নজরুলের পরিচিতি ও সাহিত্যিক অবদান
কাজী নজরুল ইসলাম শুধু বিদ্রোহী কবি নন, তিনি মানবতার কবি। তাঁর জন্ম ১৮৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়ায়। জীবনের শুরু থেকেই দারিদ্র্য, বৈষম্য, শোষণ দেখেছেন। এই অভিজ্ঞতা তাঁর কবিতায় গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। নজরুলের সাহিত্যকর্মে বিদ্রোহ, সাম্য, মানবতার বার্তা বারবার ফিরে এসেছে। তিনি ‘বিদ্রোহী’, ‘মানুষ’, ‘সাম্যবাদী’—এমন বহু কবিতায় মানবতার জয়গান গেয়েছেন।
‘মানুষ’ কবিতার উৎস ও প্রাসঙ্গিকতা
‘মানুষ’ কবিতাটি তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া। এই কবিতা আজও সমান প্রাসঙ্গিক, কারণ সমাজে ধর্ম, জাত, বর্ণের নামে বিভাজন এখনো আছে। নজরুল এখানে বলছেন, ধর্মের চেয়ে বড়ো কিছু নেই—মানুষের চেয়ে বড়ো কিছু নেই। ধর্ম, মন্দির, মসজিদ—সবই মানুষের জন্য। মানুষ না থাকলে এসব অর্থহীন।
মানুষ কবিতার সারাংশ ও মূল বার্তা
কবিতার কাহিনি ও চরিত্র
কবিতায় দেখা যায়, এক মুসাফির (ভবঘুরে, দরিদ্র) ক্ষুধার্ত অবস্থায় মসজিদে গিয়ে আশ্রয় চায়। মসজিদের মোল্লা তাকে আশ্রয় না দিয়ে তাড়িয়ে দেন। একইভাবে মন্দিরের পুরোহিতও তাকে সাহায্য করেন না। অথচ ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে, মানুষকে সাহায্য করাই আসল ধর্ম। এখানে কবি দেখিয়েছেন—ধর্মের নামে যারা বিভেদ করে, তারা আসলে মানবতাবিরোধী।
মূল বার্তা
- মানুষের উপরে কিছু নেই: ধর্ম, জাত, বর্ণ—সব মানুষের জন্য। মানুষের উপকারই আসল ধর্ম।
- ধর্মের অপব্যবহার: মোল্লা, পুরোহিত—ধর্মীয় নেতারাও অনেক সময় মানবিকতা ভুলে যান।
- সাম্য ও মানবতা: সবাই সমান, সবার অধিকার এক। সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করা অন্যায়।
মানুষ কাজী নজরুল ইসলাম ব্যাখ্যা: বিশ্লেষণ
মানবতাবাদ ও সাম্যবাদের চেতনা
নজরুলের চোখে মানুষ মানে—সৃষ্টির সেরা, যার উপরে কিছু নেই। তিনি ধর্ম, জাত, বর্ণ, ধন-সম্পদের বিভাজন মানেন না। কবিতায় বারবার বলেছেন, “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।” এই চেতনা সমাজে সাম্য, সহানুভূতি ও সহনশীলতা গড়ে তোলে।
ধর্ম ও মানবিকতার দ্বন্দ্ব
কবিতায় মোল্লা ও পুরোহিতের আচরণ দেখিয়ে নজরুল দেখিয়েছেন, ধর্মের আসল উদ্দেশ্য মানবসেবা। ধর্মগ্রন্থে যা বলা আছে, বাস্তবে অনেকেই তা মানে না। কবিতার ভাষায়—“পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল মূর্খরা সব শোন, মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন।” অর্থাৎ, ধর্মগ্রন্থ মানুষের জন্য, মানুষ ধর্মগ্রন্থের জন্য নয়।
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
নজরুল বলেছেন, “মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম—হিন্দু-মুসলমান।” ধর্মের নামে বিভেদ, হিংসা—এসব তিনি কখনো মানেননি। তাঁর কবিতায় বারবার এসেছে অসাম্প্রদায়িকতার ডাক।
মানুষ কবিতার মূল শিক্ষা ও বাস্তব প্রয়োগ
সমাজে প্রয়োগ
- সহানুভূতি: পথের ক্ষুধার্ত, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
- বৈষম্য দূরীকরণ: জাত, ধর্ম, বর্ণ—এসবের উর্ধ্বে উঠে সবার প্রতি সমান আচরণ।
- মানবিকতা: ছোট ছোট কাজ—একটু সাহায্য, একটু ভালোবাসা—এতেই মানবতার প্রকাশ।
শিক্ষার্থীদের জন্য
- মূল্যবোধ শিক্ষা: ‘মানুষ’ কবিতা পড়ে শিক্ষার্থীরা মানবিকতা, সহানুভূতি, সহনশীলতা শিখতে পারে।
- সামাজিক দায়িত্ব: সমাজে বিভেদ দূর করতে নজরুলের এই বার্তা অত্যন্ত কার্যকর।
কাজী নজরুল ইসলামের অন্যান্য মানবতাবাদী কবিতা
কবিতার নাম | মূল বার্তা | প্রকাশকাল |
---|---|---|
বিদ্রোহী | স্বাধীনতা, বিদ্রোহ | ১৯২২ |
সাম্যবাদী | সাম্য, মানবতা | ১৯২৫ |
মানুষ | মানবিকতা, সাম্য | ১৯২৫ |
খুকি ও কাঠবিড়ালি | শিশুদের মানবিক শিক্ষা | ১৯২৩ |
নজরুলের কবিতায় মানবতার বৈশিষ্ট্য
- ধর্ম, জাতি, বর্ণের উর্ধ্বে মানুষ
- মানবিকতা ও সহানুভূতির শিক্ষা
- সাম্য ও অসাম্প্রদায়িকতার বার্তা
- শোষণ, বৈষম্য, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
মানুষ কবিতার গুরুত্বপূর্ণ চরণ ও ব্যাখ্যা
- “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই”
- মানুষের উপরে কিছু নেই—এই চেতনা সমাজে সাম্য ও মানবিকতা প্রতিষ্ঠা করে।
- “পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল মূর্খরা সব শোন/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন”
- ধর্মগ্রন্থ মানুষের জন্য, মানুষ ধর্মগ্রন্থের জন্য নয়।
- “মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম—হিন্দু-মুসলমান”
- ধর্মের নামে বিভেদ নয়, সবাই একই মায়ের সন্তান।
মানুষ কবিতা নিয়ে কিছু প্রচলিত প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
মানুষ’ কবিতার মূল শিক্ষা কী?
মূল শিক্ষা—মানুষের উপরে কিছু নেই। মানবিকতা, সহানুভূতি, সাম্য—এই তিনটি মূলমন্ত্র।
২. কবিতায় ধর্মের ভূমিকা কীভাবে দেখানো হয়েছে?
ধর্মের আসল উদ্দেশ্য মানবসেবা, কিন্তু বাস্তবে অনেক সময় ধর্মীয় নেতারা মানবিকতা ভুলে যান—এটাই দেখানো হয়েছে।
৩. নজরুলের ‘মানুষ’ কবিতা আজকের সমাজে কতটা প্রাসঙ্গিক?
খুবই প্রাসঙ্গিক। আজও ধর্ম, জাত, বর্ণের নামে বিভেদ আছে। নজরুলের বার্তা—সবাই সমান, সবাই মানুষ—এখনো সমান জরুরি।
৪. শিক্ষার্থীদের জন্য এই কবিতার গুরুত্ব কী?
শিক্ষার্থীরা মানবিকতা, সহানুভূতি, সহনশীলতা শিখতে পারে। সমাজে ভালো মানুষ হতে এই শিক্ষা দরকার।
৫. নজরুলের অন্য কোন কবিতায় মানবতার কথা এসেছে?
‘বিদ্রোহী’, ‘সাম্যবাদী’, ‘খুকি ও কাঠবিড়ালি’—এসব কবিতাতেও মানবতার বার্তা আছে।
মানুষের উপরে কিছু নেই—নজরুলের চেতনায় আজকের সমাজ
আপনি যদি মানবিক সমাজ গড়তে চান, নজরুলের ‘মানুষ’ কবিতার শিক্ষা কাজে লাগান। ধর্ম, জাত, বর্ণ—এসবের উর্ধ্বে উঠে মানুষের পাশে দাঁড়ান। ছোট্ট একটা সাহায্য, একটু ভালোবাসা—এতেই মানবতার প্রকাশ। নজরুলের ভাষায়, “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই”—এই চেতনাই হোক আপনার জীবনের দিশা।